শনিবার; ০৪ জানুয়ারি ২০২৫; ২০ পৌষ ১৪৩১

টিআরএনবির বৈঠক: এসএমপি গাইডলাইনের কার্যকর বাস্তবায়নের আহ্বান ছবি- সংগৃহীত

টিআরএনবির বৈঠক: এসএমপি গাইডলাইনের কার্যকর বাস্তবায়নের আহ্বান

-ইনফোটেক ইনসাইট ডেস্ক

Published : ১৮:১৯, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

টেলিকম রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (টিআরএনবি) আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে স্থিতিশীলতা ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে সিগনিফিক্যান্ট মার্কেট পাওয়ার (এসএমপি) গাইডলাইনের কার্যকর বাস্তবায়নের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন, এসএমপি গাইডলাইন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে ছোট অপারেটরদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। একইসাথে, অবকাঠামো শেয়ারে উৎসাহ বাড়বে এবং এই খাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে।

টিআরএনবির সভাপতি সমীর কুমার দের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টিআরএনবির সাংগঠনিক সম্পাদক আল আমিন দেওয়ান। মূল প্রবন্ধে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের মধ্যে একটি একক বৃহৎ অপারেটরের আধিপত্যের কারণে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। যদিও এই অবস্থা থেকে উত্তরণে ৪ বছর আগেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসএমপি গাইডলাইন নিয়ে আসার মতো পদক্ষেপ নিয়েছিল। তারপরও অনেক অপারেটর দেশ ছেড়ে যাচ্ছে এবং এই খাতে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে।

প্রধান প্রধান উদ্বেগ: মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের (এমএনও) ধারাবাহিক বিনিয়োগ সত্ত্বেও, প্রতিবছর গ্রাহকপ্রতি গড় আয় (এআরপিইউ) কমে যাচ্ছে বলে গোলটেবিল বৈঠকে প্রকাশ করা হয়। ২০০৯ সালে যে এআরপিইউ ছিলো ৩ ডলার, তা বিগত বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যহারে কমে গিয়ে বর্তমানে ১.৩ ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে।

কমতে থাকা এই এআরপিইউ-এর সাথে যুক্ত হওয়া উচ্চ করের বোঝা, এই খাতের প্রবৃদ্ধিকে গতিহীন করছে। উচ্চ কর ও তীব্র প্রতিযোগিতা ছোট অপারেটরদের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে; ফলে, খাতটির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হার ১১ শতাংশ হলেও, টেলিকম খাতের রাজস্ব ২০২০ সালের ৬.৩৯ শতাংশ থেকে কমে ২০২৪ সালে ৪.৪০ শতাংশে এসে নেমেছে। গত পাঁচ বছরে এই খাতের রাজস্ব প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব সমস্যার অনেকগুলোই এসএমপি নীতিমালা বাস্তবায়নে শিথিলতার কারণে দেখা দিচ্ছে। এসএমপি অপারেটরটি বর্তমানে বাজার হিস্যার ৯০ শতাংশেরও (নেট প্রফিট আফটার ট্যাক্স) বেশি লাভ করছে। রাজস্ব বাজারের ৫০ শতাংশের মতো বাজার তাদের দখলে; এমনকি, শেয়ারযোগ্য অবকাঠামোর ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করলেও তারা তা শেয়ার করতে অনাগ্রহী। এতে করে এই খাতে কেবল নতুন বিনিয়োগকারীরাই নিরুৎসাহিত হচ্ছে না; বরং, বাজারে থাকা পক্ষগুলোও নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে।

বৈঠকে উল্লেখ করা হয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ২০১৮ সালে এসএমপি গাইডলাইন চালু করলেও এর গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো কার্যকরভাবে পর্যালোচনা বা বাস্তবায়ন করেনি।

গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী এই খাতের অংশীজনদের মাঝে আরও বেশি সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে বলেন, নিয়ন্ত্রক হিসেবে বিটিআরসির নিজের কোনও ক্ষমতা নেই; তাদের সরকারের কাছ থেকে পূর্ব অনুমোদন নিতে হয় এটি অসম প্রতিযোগিতার পেছনে মূল সমস্যা। বিভিন্ন আইনে ও নীতিমালায় আকস্মিক পরিবর্তন আরেকটি সমস্যা। তবে, এসএমপি প্লেয়ারের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এখন, আপনাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। খাত সংশ্লিষ্টদের মাঝে সহযোগিতা বা অংশীদারিত্বের কোনও বিকল্প নেই। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। টেলিকম খাতের উচিত হবে গ্রাহকদের ক্ষমতায়নে আরও মনোনিবেশ করা। সেবার মান বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ব্যবসাকে সমর্থন করা হবে।

বৈঠকে বক্তারা আরও জানান, এ ধরনের বৈষম্য সব অপারেটরদের জন্য কেবল সমান ক্ষেত্র তৈরিকে বাধাগ্রস্ত করছে না; একইসাথে, এটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহী করে তুলছে এবং বাংলাদেশে তাদের পুনরায় বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে।

প্রতিযোগিতা কমিশনের সাবেক পরিচালক মো. খালেদ আবু নাসের প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরও কার্যকর করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ১৫ অক্টোবর থেকে প্রতিযোগিতা কমিশন অকার্যকর। এদিকে, বিটিআরসির সাথে কমিশনের তেমন কোনও লিয়াজোঁ নেই।

ফরেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহী পরিচালক ও সিইও টিআইএম নুরুল কবির বলেন, কাউকে রাজনৈতিক সুবিধা না দিয়ে বরং ভাবতে হবে আমাদের একীভূত লাইসেন্স মডেল প্রয়োজন কিনা। তবে এই খাতের উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বিটিআরসির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা উচিত। পাশাপাশি, আরও বেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য আইন ও নীতিমালার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এমটবের সেক্রেটারি জেনারেল লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জুলফিকার বলেন, টেলিযোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। এই খাতে অনেকেই বিনিয়োগ করেছে। আরও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই খাতের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে পুরো খাতকে সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতির মধ্য থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

রবির হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স সাহেদুল আলম বলেন, ন্যায্য বাজার প্রতিযোগিতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু বাস্তবতা হলো টেলিকম খাতে সুস্থ প্রতিযোগিতার কোনও পরিবেশ নেই। একটি অপারেটর প্রতি বছর বিপুল মুনাফা অর্জন করছে। এর কারণ হলো টেলিকম বিধিমালা বৃহৎ অপারেটরদের সুবিধা দিচ্ছে, অন্যদিকে ছোট অপারেটরদের প্রবৃদ্ধি ব্যাহত করছে।

বাংলালিংকের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স তাইমুর রহমান বলেন, ইতোমধ্যে যেসব নিয়মনীতি আছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল মাবুদ চৌধুরী বলেন, অসম প্রতিযোগিতার এতোটাই খারাপ অবস্থা যে, এটা নিয়ে বলার পরিস্থিতিই নেই। অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিদ্যমান; এই প্রতিযোগিতার মাঝে টেলিটক কষ্ট করে টিকে আছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম বলেন, টেলিযোগাযোগ খাতে সুস্থ প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে এবং বিদ্যমান বিনিয়োগ ধরে রাখতে প্রতিযোগিতা আইন নিয়ে কথা বলতে হবে। সিগনিফিক্যান্ট মার্কেট পাওয়ার (এসএমপি) গাইডলাইনে ২০টি ধারা আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করা হয়েছে মাত্র তিনটি, যা বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠায় তেমন ভূমিকা রাখেনি। বিটিআরসিকে আইনে ক্ষমতা দেওয়া আছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সেই ক্ষমতার কার্যকর ব্যবহার করা হচ্ছে না।

এমএএইচ

শেয়ার করুনঃ