শনিবার; ১৯ এপ্রিল ২০২৫; ৬ বৈশাখ ১৪৩২

স্টারলিংক, দেশীয় আইএসপি এবং খোলা বাজার ছবি: ইনফোটেকইনসাইট ডট কম

স্টারলিংক, দেশীয় আইএসপি এবং খোলা বাজার

হিটলার এ. হালিম

Published : ১২:৩৪, ১৯ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে, স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক বাণিজ্যিকভাবে দেশে পা রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরইমধ্যে স্টারলিংকের টেস্ট রান সম্পন্ন হয়েছে। উচ্চগতির ইন্টারনেট মোবাইলে ব্যবহার করতে পেরে ব্যবহারকারীরা খুশি।

কিন্তু সামগ্রিক বিষয়টি কতটা সফলতা পাবে সেটা নিয়ে আলোচনা-তর্ক চলছে এবং এ তর্ক কখনও শেষ হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও দেশের ইন্টারনেট খাত সংশ্লিষ্টরা নতুন এই প্রযুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা মনে করছেন, এর (স্টারলিংক) পাশাপাশি দেশীয় উদ্যোক্তাদের (আইএসপি ব্যবসায়ী) সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে তা না হলে তারা ধংস হয়ে যাবে। একটির আগমনে অন্যরা যেন বাজার থেকে হারিয়ে না যায় সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। বরং এ সময়ে আইএসপি উদ্যোক্তাদের কোয়ালিটি অব সার্ভিস আরও উন্নত করতে হবে। গ্রাহককে ভালো সেবা দেওয়ার কোনও বিকল্প নেই।

বাংলাদেশে ফাইবার অপটিকভিত্তিক ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের প্রসারে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা দীর্ঘদিনের চ্যালেঞ্জ। মেট্রোপলিটন শহর ও জেলা পর্যায়ে শক্তিশালী সংযোগ ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি। বেসরকারি খাতের অবকাঠামোর নির্ভরযোগ্যতাও সবসময় নিশ্চিত করা যায় না। এমন পরিস্থিতিতে স্টারলিংকের স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট দ্রুত বাজারে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে উপজেলা, ইউনিয়ন ও শিল্প এলাকায়, যেখানে ফাইবার সংযোগ দুর্বল, সেখানে স্টারলিংক গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে।

কর্পোরেট খাতে স্টারলিংকের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট রেডিও বা অন্যান্য ব্যয়বহুল প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে। স্টারলিংক এই ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী সমাধান দিতে পারে, যা কর্পোরেট গ্রাহকদের জন্য আকর্ষণীয় হবে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিমত জানিয়েছেন।

দেশীয় আইএসপি ও মোবাইল অপারেটরের ওপর প্রভাব

স্টারলিংকের আগমন দেশীয় ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (আইএসপি) জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। নাইজেরিয়ায় স্টারলিংক ২০২৩ সালে ব্যবসা শুরু করে দ্রুত বাজারের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এর ফলে ছোট আইএসপিগুলো ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। বাংলাদেশেও একই পরিস্থিতি হতে পারে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

তবে কেউ কেউ বলছেন, উত্তর আমেরিকা ছাড়া অন্যান্য দেশে স্টারলিংকের গ্রাহকসংখ্যা এখনও তুলনামূলক কম। স্টারলিংক সরাসরি প্রতিযোগী হওয়ার পরিবর্তে বিদ্যমান ইন্টারনেট ব্যবস্থার পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে। বিশেষ করে কর্পোরেট গ্রাহকরা ব্যাকআপ সংযোগ হিসেবে স্টারলিংক বেছে নিতে পারে।

মোবাইল অপারেটররাও স্টারলিংকের সঙ্গে সহযোগিতার সম্ভাবনা দেখছে। বিশ্বের কিছু মোবাইল অপারেটর স্যাটেলাইট-চালিত মোবাইল সেবার জন্য স্টারলিংকের সঙ্গে অংশীদারত্ব করছে। বাংলাদেশে ফাইবার সংযোগের অভাব পূরণে স্টারলিংক ব্যাকহল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সরাসরি স্যাটেলাইট সেবা চালু হলে সরকার স্পেকট্রাম বিক্রির রাজস্ব হারাতে পারে। এ কারণে স্থানীয় অপারেটরদের সঙ্গে অংশীদারত্ব জরুরি।

দামের প্রশ্ন ও গ্রাহক সামর্থ্য

স্টারলিংকের সেবা বাংলাদেশে সাশ্রয়ী হবে কি না এটা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। অন্যান্য দেশে স্টারলিংকের হার্ডওয়্যার কিটের দাম ৬০০ ডলার পর্যন্ত এবং মাসিক সাবস্ক্রিপশন ফি ৩০ থেকে ৫০ ডলার। বাংলাদেশে বাসা-বাড়ির গ্রাহকদের গড় ইন্টারনেট খরচ মাসিক ৫০০-৬০০ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে স্টারলিংকের বর্তমান দাম সাধারণ গ্রাহকদের জন্য সাশ্রয়ী নাও হতে পারে।বাংলাদেশে ব্যবসা করতে হলে স্টারলিংককে দাম কমাতে হবে। অপরদিকে কর্পোরেট গ্রাহক, যাদের গড় খরচ মাসে ১২-১৫ হাজার টাকা, তারা এই দাম মানিয়ে নিতে পারবে। এছাড়া অ্যাপার্টমেন্ট বা হাসপাতালের মতো কমিউনিটিভিত্তিক ব্যবহারের মাধ্যমে খরচ ভাগ করে নেওয়া সম্ভব।

অবকাঠামো ও সহযোগিতার প্রয়োজন

স্টারলিংকের সেবা চালু করতে বাংলাদেশে আর্থ স্টেশন বা গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন অপরিহার্য। গাজীপুর, কক্সবাজার, যশোর ও চট্টগ্রামে এ ধরনের স্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। ডেটা ট্রান্সমিশনের জন্য স্টারলিংককে এনটিটিএন অপারেটরদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকারের উচিত এমন নীতি প্রণয়ন করা, যাতে ছোট আইএসপিগুলো স্টারলিংকের ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলে যুক্ত হতে পারে। আইএসপিদের পোর্টেবল স্যাটেলাইট বিক্রির অনুমতি দেওয়া হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেবা পৌঁছানো সহজ হবে।

ফাইভ-জি ও ভবিষ্যতের প্রস্তুতি

বাংলাদেশে ফাইভ-জি চালুর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এখনও তৈরি হয়নি। ব্যাকহল ও হ্যান্ডসেটের ঘাটতি এবং সরকারের কিছু নীতিগত সীমাবদ্ধতা এ ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে। স্টারলিংকের আগমনের পর মোবাইল অপারেটরগুলো কীভাবে বাজার ধরে রাখবে, তা নিয়ে তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তবে তাদের মূল লক্ষ্য ম্যাস মার্কেট, যেখানে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট এখনও তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।

সরকারি নীতি ও প্রতিযোগিতার গুরুত্ব

স্টারলিংক বাংলাদেশে অফিস স্থাপন এবং স্থানীয় আইআইজির মাধ্যমে ইন্টারনেট রাউটিং করবে। এর ফলে সরকার প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ ও আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবে। তবে ইন্টারনেটের মৌলিক অধিকার বিবেচনায় নীতিমালা প্রণয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়।

শুধু স্টারলিংক নয়, অন্যান্য স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারীদেরও বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো উচিত। প্রতিযোগিতা বাড়লে গ্রাহকরা উন্নত সেবা ও সাশ্রয়ী দামে ইন্টারনেট পাবেন। এতে বিদ্যমান আইএসপিগুলোও সেবার মান বাড়াতে উৎসাহিত হবে।

স্টারলিংকের আগমন বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। দুর্বল অবকাঠামোগত এলাকা ও কর্পোরেট খাতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি হবে। তবে দাম, স্থানীয় আইএসপি ও টেলকোর সঙ্গে সহযোগিতা এবং সরকারি নীতি এর সাফল্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেলে গ্রাহকরাই শেষ পর্যন্ত লাভবান হবেন। বাংলাদেশের ডিজিটাল ভবিষ্যৎ গড়তে স্টারলিংক হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, তবে এর পথচলা নির্ভর করবে সঠিক পরিকল্পনা ও সহযোগিতার ওপর।

এমএএইচ

শেয়ার করুনঃ