বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতের বাজার ২০১৭-২০৩১
Published : ১৫:০৭, ৭ নভেম্বর ২০২৪
আমিনুল হাকিম আম্বার আইটি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইআইজিএবি) বর্তমান সভাপতি। এর আগে তিনি দেশের ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবি-তে একাধিকবারের সভাপতি ছিলেন। দীর্ঘদিন টেলিযোগাযোগ খাতে কর্মরত থাকায় কাছ থেকে দেখেছেন এই সেক্টরের যাত্রা, ক্ষেত্র তৈরি, উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ইত্যাদি। ভবিষ্যত গতিপথও তিনি দেখতে পাচ্ছেন। সেসব তিনি তুলে ধরছেন ধারাবাহিকভাবে টেকটক বিভাগে। আজ চতুর্থ পর্ব।
২.৪ টেলিযোগাযোগ বাজার মূলধন ব্যয়, ২০১৭-২০৩১
২.৪.১ টেলিযোগাযোগ ক্যাপেক্স ব্যয় ২০১৭-২০২৩
সারণি ৪-এ বাংলাদেশের গত ৭ বছরে সবচেয়ে বড় টেলিযোগাযোগ অপারেটরদের জন্য ঐতিহাসিক ক্যাপেক্স (মূলধনী ব্যয়) দেখানো হয়েছে। ক্যাপেক্স থেকে জিডিপি অনুপাত ২০১৭ সালে ০.২৪ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ০.১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। এই পতন গত পাঁচ বছরে ফাইবার এবং টাওয়ার অবকাঠামো বিনিয়োগের ঘাটতিকে তুলে ধরে। কারণ দেশের সামগ্রিক জিডিপি গড় প্রবৃদ্ধি ১১.৫ শতাংশ এগিয়েছে, যা বিশ্বের দ্রুততম জিডিপির মধ্যে একটি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও ২০২৩ সালে দেশে ক্যাপেক্স ব্যয় ২০২২ সালের ৬ দশমিক ৯ হাজার কোটি টাকা থেকে কিছুটা বেড়ে ৭ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আইডেম ইস্ট রিসার্চের ধারণা অনুযায়ী ২০২৪-৩১ পূর্বাভাস সময়কালে অনুপাতটি প্রায় ০ দশমিক ১ শতাংশ হারে হ্রাস পেতে থাকবে। এদিকে আইডেম ইস্ট রিসার্চ আশা করছে ২০৩১ সালের মধ্যে নেটওয়ার্ক বিনিয়োগ গড়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশ হারে ১১৩ বিলিয়ন টাকা (১ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বৃদ্ধি পাবে। ক্যাপেক্স এবং বিক্রয় অনুপাত ১৩ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে স্থির হওয়া উচিত যার মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যেমন ফাইবার ব্যাকহল থেকে মোবাইল টাওয়ার, এফটিটিএইচ হোমস পাসড এবং আসন্ন ফাইভ-জি বিনিয়োগ অনুপাত ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ করা উচিত।
আমদানি নিষেধাজ্ঞা ও বিটিআরসির সঙ্গে চলমান কর বিরোধের কারণে ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা ওঠার পর ২০১৯ সালে মূলধন বিনিয়োগ কমিয়েছে গ্রামীণফোন। অপরদিকে রবি আজিয়াটা তাদের ফোরজি কাভারেজ এবং বর্ধিত ডেটা চাহিদা পূরণের সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিয়ে ক্যাপেক্স-টু-সেল অনুপাত বজায় রেখে স্থির বিনিয়োগ করেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। বাংলালিংক ২০২২ সালে অতিরিক্ত মোবাইল টাওয়ার ও ফাইবার রুট নির্মাণ করে ব্যাপক সফলতার পর ২০২৩ সালে তাদের বিনিয়োগ কমিয়ে ১১ দশমিক ৩ বিলিয়ন টাকায় নামিয়ে এনেছে।
কয়েক দশক ধরে প্রতিযোগিতার জন্য বাজার উন্মুক্ত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে ক্যাপেক্স বিনিয়োগে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনও পিছিয়ে রয়েছে। মোবাইল ইন্টারনেটে প্রবেশের দিকে নিজেদের পরিচালিত করতে অপারেটররা তাদের নিজ নিজ ফোর-জি রোলআউট অনুসরণের মাধ্যমে অপারেটররা তাদের কৌশলগুলো পর্যালোচনা করে যাচ্ছে এবং একটি অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপের মধ্যে একটি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক বাজারে লাভজনক উপায় খুঁজছে যা পরবর্তী বিনিয়োগের জন্য প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা যাচ্ছে। জাতীয় নীতিমালার অভাবে ফিক্সড ব্রডব্যান্ড বিনিয়োগ কেবল শত শত ছোট ফাইবার অপারেটরদের নিয়ে উঠে আসছে। এই নব্য গ্রিনফিল্ড বাজারে আগে অবস্থান দখল করতে ছোট সরবরাহকারীদের সঙ্গে ফাইবার-টু-দ্য-হোম অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করছে।
২.৪.২ রাজস্ব বেঞ্চমার্ক থেকে ক্যাপেক্স
দেশি মোবাইল অপারেটররা ফোর-জিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, গ্রামীণফোন ও রবি ২০১৭ সালে ক্যাপেক্স-বিক্রয় অনুপাতের প্রায় ৩৫ শতাংশ অবদান রেখেছে। এদিকে গ্রামীণফোন ১৩ শতাংশ অনুপাতে থেকে উল্লেখযোগ্য হারে পিছিয়ে পড়েছে। নেটওয়ার্ক বিল্ড ফোর-জি প্রাথমিক সমাপ্তিতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে এবং নতুন বিনিয়োগের ক্ষমতা এবং কাভারেজ বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকায় এই অনুপাতটি এখন প্রায় ১৩-১৪ শতাংশের স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন। মোবাইল ব্যাকহল এবং এফটিটিএইচ বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। আমরা দেখেছি, ২০২৩ সালে মোবাইল টাওয়ারগুলোতে ফাইবার ব্যাকহল সংযোগের ক্ষেত্রে যেখানে ভারতের রয়েছে ৩৫ শতাংশ সেখানে আমাদের ২০ শতাংশেরও কম। চিত্র ৭ অনুযায়ী এফটিটিএইচ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে ক্ষুদ্র ফাইবার অপারেটররা মাঝারিমাণের ব্যয় করলেও টেলিটকের ক্যাপেক্স ১৪ শতাংশে নেমে এসেছে। আইডেম ইস্ট রিসার্চ আশা করছে, দেশের ফোরজি ক্ষমতা এবং কাভারেজ, এফটিটিএইচ রোলআউট উন্নত করতে আগামী ৭ বছরে এই অনুপাতটি প্রায় ১৪ শতাংশে বজায় থাকবে। এরপর ২০২৪ সালের মধ্যে ফাইভ-জি বিনিয়োগের পরবর্তী তরঙ্গ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উৎস: কোম্পানি রিপোর্ট, আইডেম ইস্ট গবেষণা অনুমান
২.৪.৩ ক্যাপেক্স থেকে জিডিপি বেঞ্চমার্ক
ক্যাপেক্স ও জিডিপি অনুপাত ০ দশমিক ১৬ শতাংশ যা আনুপাতিক দিক দিয়ে এই অঞ্চলের মধ্যে ক্ষুদ্রতম। যেখানে ২০১৭ সালে দেশের শীর্ষ তিনটি মোবাইল অপারেটরের ফোর-জি নেটওয়ার্ক রোলআউটের সময় এই অনুপাত ছিল ০ দশমিক ২৪ শতাংশ। চিত্র ৮-এ দেখায় যে ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার অনুপাত বাংলাদেশের তুলনায় বেশি। তাদের গড় ক্যাপেক্স থেকে জিডিপি অনুপাত যথাক্রমে ০ দশমিক ৭৪ এবং ০ দশমিক ৩১ শতাংশ। অপরদিকে ভারতীয় অনুপাত এখন ২০২৩ সালে ০ দশমিক ২৬ শতাংশে নেমে এসেছে এবং চীন ০ দশমিক ৩২ শতাংশে অবস্থান করছে।
আইডেম ইস্ট রিসার্চের ধারণা অনুযায়ী, দেশের টেলিকম অপারেটররা ২০২৪-২০৩১ সময়কালে টেলিযোগাযোগ বিনিয়োগে জিডিপির খুব কম, ০ দশমিক ১২ শতাংশ বজায় রাখবে। আর এর মাঝেই তাদের সম্পন্ন করতে হবে ফোর-জি রোলআউট, ক্ষমতা বৃদ্ধি, ফাইভ-জি চালুকরণ, আরও গ্রামীণ অঞ্চলে এফটিটিএইচ সম্প্রসারণ, মোবাইলে বিনিয়োগ বজায় রাখা এবং ডিজিটাল বৈষম্য বন্ধ করা ইত্যাদি।
২.৪.৪ টেলিযোগাযোগ ক্যাপেক্স ব্যয়ের পূর্বাভাস, ২০০০-২০৩০
টেলিযোগাযোগ অপারেটরদের মূলধন ২০০০ সালে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০১৬ সালে তিনগুণ হয়েছে। মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে ফোর-জি কাভারেজ বাড়ানো, শক্তিশালী ডেটা চাহিদা পূরণের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং স্মার্টফোনের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। আইডেম ইস্ট রিসার্চ আশা করছে, ২০২৪-৩১ পূর্বাভাস সময়ের তুলনায় বার্ষিক ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হারে ক্যাপেক্স ব্যয় ২০২৩ সালের ৭ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০৩১ সালের মধ্যে ১১ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় উন্নীত হবে।
চিত্র ৯ এবং টেবিল ৫ -এ তিন দশকেরও বেশি সময়ে আনুমানিক তথ্য এবং ২০৩১ -এর পূর্বাভাস-সহ ক্যাপেক্স ব্যয়ের ৩০ বছরের ওভারভিউ দেখানো হলো। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও রবি আজিয়াটার মধ্যে নতুন মোবাইল নেটওয়ার্ক বিল্ডআউটের ফলে ক্যাপেক্সের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভবিষ্যতে ফোরজি আপগ্রেড, ফাইভ-জি বিস্তার এবং এফটিটিপি খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
আইডেম ইস্ট রিসার্চ তার ক্যাপেক্স পূর্বাভাসকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে কারণ সব অপারেটর সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করছে। অর্থনৈতিক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তৃত্বের অনিশ্চয়তা সেইসঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও কর অফিসের মাঝে আইনি বিরোধে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে এবং টেলিযোগাযোগে গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগে সুযোগের সর্বশেষ সম্ভাবনাকেও হ্রাস করছে।
আগের পর্বগুলো-
পর্ব-১: https://www.infotechinsight.com/tech-talk/news/139
পর্ব- ২: https://www.infotechinsight.com/tech-talk/news/142
পর্ব-৩: https://www.infotechinsight.com/tech-talk/news/144
এমএএইচ