বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতের বাজার ২০১৭-২০৩১
Published : ১২:৫৪, ১৪ আগস্ট ২০২৪
আমিনুল হাকিম আম্বার আইটি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইআইজিএবি) বর্তমান সভাপতি। এর আগে তিনি দেশের ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবি-তে একাধিকবারের সভাপতি ছিলেন। দীর্ঘদিন টেলিযোগাযোগ খাতে কর্মরত থাকায় কাছ থেকে দেখেছেন এই সেক্টরের যাত্রা, ক্ষেত্র তৈরি, উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ইত্যাদি। ভবিষ্যত গতিপথও তিনি দেখতে পাচ্ছেন। সেসব তিনি তুলে ধরছেন ধারাবাহিকভাবে টেকটক বিভাগে। আজ প্রথম পর্ব।
জাতিসংঘ ঘোষিত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো এর সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনেক দূরদর্শী সম্পন্ন। অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি ব্যতিক্রমধর্মী সফলতার পথে এগিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৭-২৩ সালে দেশের অর্থনীতি বেড়েছে গড়ে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ। ফলে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ।
দেশটির দারিদ্র্যসীমা যেখানে ২০০১ সালে ছিল ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৫ শতাংশে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ স্বীকৃতি পায় নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে। আমাদের আশা শিগগিরই দেশটি উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করতে পারবে, সে লক্ষ্যে দেশ এগিয়ে চলেছে।
বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাত বাজার প্রতিনিধিত্বকারী এবং গতিশীল। বলা যায়, এই বাজার মোবাইল এবং ফিক্সড ডিজিটাল অবকাঠামোতে বিনিয়োগের প্রকৃত জায়গা, শেষ সীমান্ত বলেও মনে করেন অনেকে। যদিও বাংলাদেশের গ্রিনফিল্ড টেলিকম বাজারের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, তবে সুযোগগুলোকে বাস্তব চ্যালেঞ্জের আলোকে দেখতে হবে। চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে ভৌত অবকাঠামো, স্থিতিশীল নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণের অভাব। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনিশ্চয়তা, প্রায়োজনের চেয়ে বেশি সংখ্যক লাইসেন্স এবং প্রতিকূল আবহাওয়া ইত্যাদি বাধাগুলো মূলত টেলিকমিউনিকেশন ডিজিটাল অবকাঠামোতে আরও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মোবাইল অপারেটরদের পাশাপাশি টাওয়ার কোম্পানিগুলোর জন্য দেওয়াল বা প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডাক ও টেলিগ্রাফ বিভাগের অধীনে টেলিগ্রাফ শাখাটি ১৮৫৩ সালে ব্রিটিশ ভারতে তৈরি হয়েছিল এবং ১৮৮৫ সালের টেলিগ্রাফ আইনের অধীনে নিয়ন্ত্রিত। পাকিস্তান টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বিভাগ ১৯৬২ সালে গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের (বর্তমানে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়) অধীনে বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ড গড়ে তোলা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাণিজ্যিক টেলিযোগাযোগ সেবা পরিচালনার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বিভাগ গঠিত হয়। ১৯৭৯ সালে বিটিটিডি (বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন ডিপার্টমেন্ট), পরে টেলিকম এবং ওয়্যারলেস পরিষেবার জন্য লাইসেন্স ইস্যু করার ক্ষমতাসহ বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন বোর্ড (বিটিটিবি) হিসেবে পুনর্গঠিত হয়।
একটি মাল্টি-অপারেটর পরিবেশে সব অপারেটরের জন্য সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার ২০০১ সালে টেলিযোগাযোগ আইনের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ নীতি সংস্কার বাস্তবায়ন করে এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) প্রতিষ্ঠা করে। এই কমিশন টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন হিসাবে কাজ করে। বিটিটিবির একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান ঘটাতে এবং একটি প্রো-কম্পিটিটিভ আন্তঃসংযোগ ব্যবস্থাকে উন্নীত করার জন্য প্রতিষ্ঠানটি কর্তৃপক্ষের কাছে দায়বদ্ধ।
১৯৯৬ সালে তিনটি কোম্পানিকে (গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক) বাংলাদেশে জিএসএম (গ্লাবাল সিস্টেম ফর মোবাইল) সিস্টেম পরিচালনার লাইসেন্স দেওয়া হয়। এরমধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান ১৯৯৭ সালে এবং অন্যটি ১৯৯৮ সালের প্রথম দিকে কাজ শুরু করে। ২০০৪ সালে বিটিটিবিকে একটি জিএসএম অপারেটরের লাইসেন্স দেওয়া হয় যা পরে টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড নামে পরিচিতি পায়।
২০০৫ সালের ডিসেম্বরে ওয়ারিদ টেলিকমকে বাংলাদেশের পঞ্চম জিএসএম অপারেটর হিসেবে লাইসেন্স দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে অপারেটরটিকে এয়ারটেল হিসাবে পুনঃব্র্যান্ড করা হয়, যা বর্তমানে মোবাইল অপারেটর রবির সাব-ব্র্যান্ড। রবি এয়ারটেলকে একীভূত করার পরে এয়ারটেল রয়েছে গেছে তার ০১৬ নম্বর সিরিজ নিয়ে।
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুততম বিকাশমান টেলিযোগাযোগ বাজারগুলোর মধ্যে একটি। সামাজিক ও জনস্বাস্থ্যের প্রভাব ছাড়াও অনিশ্চিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতি ও মুদ্রাস্ফীতির চাপ সত্ত্বেও আইডেম ইস্ট রিসার্চ আশা করে দেশের এই টেলিকমিউনিকেশন শিল্প তাদের অগ্রগতি ও প্রবৃদ্ধি বজায় রাখবে। এই খাতের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা প্রশংসনীয়। ক্রমবর্ধমান মোবাইল ফোনের প্রবেশ এবং পরিবারের মধ্যে ক্রমবর্ধমান নির্দিষ্ট ব্রডব্যান্ড গ্রহণ আগামী আট বছরে ভবিষ্যত প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। আইডেম ইস্ট রিসার্চ আশা করছে, মোবাইল সাবস্ক্রিপশন ২০২৩-৩০ সালে বার্ষিক গড় ২ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে এবং একই সময়ের মধ্যে ব্রডব্যান্ড গ্রাহকের সংখ্যা গড়ে ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। ২০২৩-৩০ সময়ের মধ্যে নতুন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বার্ষিক গড় ১২ দশমিক ৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই হার হবে ৮০ দশমিক ২ শতাংশ।
প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সংখ্যক টেলিকম লাইসেন্স প্রদান দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্রডব্যান্ড সাপ্লাই চেইন ভেঙে দেয় এবং ২০০৭ সালে লাইসেন্সগুলোকে অনেকগুলো ভাগে ভাগ করে দেয়। টেলিকমিউনিকেশন অপারেটররা এখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গেটওয়ে, সাবমেরিন ক্যাবল, আইএসপি, পিয়ারিং, ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ এবং আরও অনেক কিছুর জন্য একাধিক লাইসেন্স রাখতে বাধ্য। কিছু লাইসেন্স যেমন- একটি মোবাইল অপারেটর জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) রাখতে পারে না।
অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সামিট কমিউনিকেশনস বাংলাদেশে ব্রডব্যান্ডের পুরো সাপ্লাই চেইন নিয়ন্ত্রণ করে। সামিটের একটি নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) লাইসেন্স রয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথ ইন্টারন্যানাল ইন্টারনেট গেটওয়েগুলোকে (আইআইজি) সরবরাহ করে। সামিটের আইআইজি লাইসেন্সও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি তার এনটিটিএন এবং টাওয়ার লাইসেন্সের ভিত্তিতে মোবাইল টাওয়ারগুলোর মধ্যে ব্যান্ডউইথ অফলোড করে। ন্যাশনাল ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ (এনআইএক্স) লাইসেন্সের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে স্থানীয় ট্রাফিক বজায় রাখার জন্য সামিট একটি পিয়ারিং আউটফিট পরিচালনা করে। (চলবে)
এমএএইচ